আধুনিকতার দাপটে যেখানে গ্রামীণ খেলাধুলা ও ঐতিহ্য ম্লান হতে বসেছে, সেখানে এখনও টিকে আছে কিছু জীবন্ত স্মৃতি। চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের সামনের ঘনিয়ারপাড় গ্রামে সহ বিভিন্ন গ্রামের খালে, বিলে সম্প্রতি এমনই এক চিত্র ধরা পড়েছে, যা যেন শৈশবের সেই চিরচেনা দিনগুলোকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
গভীর কাদা-মাটিতে নেমে দল বেঁধে মানুষ মাছ ধরছে—হাতে কাঁইচা, বালতি, ঝাঁকি ও খালি হাতেই চলছে প্রাণপণ চেষ্টা। কেউ হেঁটে, কেউ গড়াগড়ি দিয়ে, কাদা সরিয়ে খুঁজে চলেছে পুঁটি, শিং, টেংরা কিংবা কৈ মাছ। পানির নিচে লুকিয়ে থাকা মাছগুলো খুঁজে বের করার আনন্দ যেন কোনও বিশাল পুরস্কারের চেয়ে কম নয়। পাশে রাখা টিনের থালায় একের পর এক জমা হচ্ছে মাছ, আর পাশ থেকে ভেসে আসছে হুল্লোড় আর আনন্দধ্বনি।
ঘনিয়ারপাড় গ্রামের রফিক সরদার (৫০) বলেন, “এই জায়গাটায় ছোটবেলায় আমরা বর্ষা শেষে প্রায়ই এমনভাবে মাছ ধরতাম। তখন তো জাল-কাঁইচা ছিল না, খালি হাতে বা বাঁশ দিয়ে বানানো ফাঁদেই ধরতাম। এখন ছেলে-মেয়েরা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু এই দৃশ্য দেখে আমি নিজেই আট-দশ বছরের হয়ে গেলাম যেন।”
শিশু রাব্বি (১১) জানায়, “আমি আগে কখনো এভাবে মাছ ধরি নাই। আজ খুব ভালো লাগছে। কাদা-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে মাছ ধরেছি। বড় ভাইরা দেখিয়েছে কিভাবে ধরতে হয়।”
স্থানীয় শিক্ষার্থী রাসেল (১৯) বলেন, “শুধু মাছ ধরা না, এটা একসাথে সময় কাটানোর, প্রাকৃতিক আনন্দে মেতে ওঠার একটা মাধ্যম। শহরে বড় হওয়া ভাই-বোনেরা কখনো এই অনুভবই পায় না। আমি নিজেও কয়েক বছর পর আজ নেমে পড়েছি।”

পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা বয়োজ্যেষ্ঠ আব্দুর রহমান নামে এক ব্যক্তি হেসে বলেন, “এই মাছ ধরার দিনগুলো শুধু আনন্দ নয়, সম্পর্ক গড়ার দিন। বাবা,চাচা, ভাই, দাদু—সবাই মিলে একসাথে মাছ ধরতাম, আর শেষে এক জায়গায় রান্না করে ভাগ করে খেতাম। এখন তো সেই গ্রামীণ উৎসবটাই আর দেখা যায় না। আজ যেন নতুন করে ফিরে পেলাম।”
স্থানীয়দের কাছে এটি শুধু মাছ ধরার একটি মুহূর্ত নয়, বরং একত্রে মিলেমিশে কাজ করার, সামাজিক বন্ধন মজবুত করার ও হারানো শৈশবের ছোঁয়া পাওয়ার এক দুর্লভ উপলক্ষ। এ ধরণের উদ্যোগ বা অভিজ্ঞতা নতুন প্রজন্মকে গ্রামবাংলার শিকড়ের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত করবে বলে মনে করছেন অনেকে।
পরিশেষে, আমাদের সমাজে যখন প্রযুক্তি ও শহুরে ব্যস্ততা গ্রামীণ জীবনের সহজ সরলতা থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, তখন গণিয়ারপাড় গ্রামের এই দৃশ্য যেন এক নতুন বার্তা দেয়—প্রকৃত আনন্দ মাটির কাছেই, শিকড়ের সঙ্গেই।